নামাজের প্রচলিত ভুল-ত্রুটি (২য় পর্ব)

৮) তাকবীর, কুরআন তেলাওয়াত ও ছালাতের অন্যান্য দুয়ার সময় ঠোঁট না নড়িয়ে শুধু মনে মনে বলাঃ এটি একটি বহুল প্রচলিত ভুল। ইমাম নববী বলেন, ইমাম ছাড়া অন্য সবার জন্য সুন্নাত হচ্ছে সবকিছু চুপে চুপে পাঠ করা। চুপে চুপে বলার সর্বনিম্ন সীমা হচ্ছে নিজেকে শোনানো- যদি তার শ্রবণ শক্তি ঠিক থাকে এবং কথায় কোন জড়তা না থাকে। এ বিধান সকল ক্ষেত্রে ক্বিরাত পাঠ, তাকবীর, রুকু সিজদার তাসবীহ্‌ প্রভৃতি। তাছাড়া ঠোঁট না নাড়ালে তো তাকে পড়া বলা চলেনা। কারণ আরবীতে এমন অনেক অক্ষর আছে ঠোঁট না নাড়ালে যার উচ্চারণই হবে না।

৯) ছানা এবং আঊযুবিল্লাহ্‌ পাঠ না করে সরাসরি বিসমিল্লাহ্‌ পড়ে সূরা ফাতিহা পাঠ করা। ছানা ও আঊযুবিল্লাহ্‌ পাঠ করা মুস্তাহাব।

১০) সূরা ফাতিহা পাঠ না করাঃ বিশেষ করে ইমামের পিছনে ছালাত আদায় করার সময় সূরা ফাতিহা অনেকে পড়ে না। অথচ সুরা ফতিহা ছাড়া ছালাত হয় না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি এমন ছালাত পড়ল যাতে সূরা ফাতিহা পড়ে নাই সে ছালাত ত্রুটিপূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ তথা অসম্পূর্ণ। (বুখারী ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ্‌ (ছাঃ) একদা ফজরের ছালাত শেষে মুছল্লীদের বললেন, তোমরা কি ইমামের পিছে পিছে কিছু পাঠ কর? আমরা বললাম, হাঁ, দ্রুত করে পড়ে নেই। তিনি বললেন, এরূপ করো না। তবে সূরা ফাতিহা পড়ে নিও। কেননা যে ব্যক্তি এ সূরা পড়বে না তার ছালাত হবে না। (আবু দাঊদ, তিরমিযী)

১১) ইমামের ওয়ালয্‌যওয়াল্লীন বলার পর কোন কোন মুছল্লী আমীন বলার পর আরো বাড়িয়ে বলে ওয়ালে ওয়ালি দাইয়্যা ওয়া লিল মুসলিমীন। এটা সুন্নাত বহির্ভূত কাজ।

১২) দন্ডায়মান এবং বসাবস্থায় পিঠ সোজা না রাখাঃ যেমন পিঠ কুঁজো করে রাখা বা ডানে-বামে হেলে থাকা। অনুরূপভাবে রুকু ও সিজদায় পিঠ সোজা না রাখা।

রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রুকু-সিজদায় পিঠ সোজা করে না, আল্লাহ্‌ তার ছালাতের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না। (ত্ববরানী ছহীহ সনদে) তিনি আরো বলেন,

أَتِمُّوا الرُّكُوعَ وَالسُّجُودَ

“তোমরা রুকু ও সিজদা পরিপূর্ণরূপে আদায় কর। (বুখারী ও মুসলিম)

১৩) রুকু অবস্থায় প্রশান্তি ও ধীরস্থীরতা অবলম্বন না করাঃ দেখা যায় অনেক মানুষ তাড়াহুড়া করে ছালাত আদায় করতে গিয়ে ভালভাবে রুকু-সিজদা করে না। রুকুর সময় পিঠ সেজা না করে মাথাটা একটু নীচু করে। মোরগের ঠোকর দেয়ার মত করে সিজদা করে। অথচ এভাবে ছালাত আদায়কারীকে হাদীছে নিকৃষ্ট ছালাত চোর বলা হয়েছে। আর তার ছালাতও বিশুদ্ধ হবে না। যায়দ বিন ওয়াহাব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযায়ফা (রাঃ) দেখলেন জনৈক ব্যক্তি অপূর্ণরূপে রুকু-সিজদা করছে। তিনি তাকে বললেন, তুমি তো ছালাত আদায় করো নি। তুমি যদি এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ কর, তবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ্‌ যে ফিতরাত (বা বৈশিষ্ট বা ইসলাম) দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তুমি তা ভিন্ন অন্য ফিতরাতের উপর মৃত্যু বরণ করবে। (বুখারী ও মুসলিম)

আবু হুরায়রা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন। তিনি দেখলেন, এক ব্যক্তি মসজিদে নববীতে প্রবেশ করে (দ্রুত) ছালাত আদায় করল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “তুমি ফিরে গিয়ে ছালাত আদায় কর। কেননা তুমি ছালাতই আদায় করো নি।” (বুখারী)

১৪) রুকু থেকে উঠার পর কোন শব্দ বাড়িয়ে বলাঃ যেমন কেউ কেউ রাব্বানা লাকাল হামদু বলার পর ওয়াশ্‌ শুকরু শব্দ বাড়িয়ে বলে। এটা সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত নয়।

১৫) রফউল ইয়াদায়ন না করাঃ অধিকাংশ মুছল্লী শুধুমাত্র তাকবীর তাহরীমা (ছালাত শুরুর সময় তাকবীর) বলার সময় রফউল ইয়াদায়ন বা হাত উত্তোলন করে থাকে; কিন্তু পরবর্তীতে রুকুর আগে ও পরে তা করে না। আবার অনেকে তাকবীর তাহরীমার সময়ও করে না। এটা সুন্নাত বিরোধী। কেননা ছহীহ্‌ বুখারী ও মুসলিমসহ বিভিন্ন গ্রন্থের একাধিক ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, উক্ত ক্ষেত্র সমূহে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত উত্তোলন করেছেন। আবদুল্লাহ্‌ বিন ওমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি দেখেছি রাসূলুল্লাহ্‌ ছালাত পড়তে দাঁড়িয়ে দুহাত কাঁধ বরাবর উঠাতেন। রুকুর তাকবীর বলার সময় এমনটি করতেন এবং রুকু থেকে মাথা উঠাবার সময় এরূপ করতেন এবং বলতেন সামিআল্লাহু লিমান হামীদাহ্‌। (বুখারী হা নং/ ৬৯২) সুতরাং মাযহাবের দোহাই দিয়ে এই সুন্নাতের প্রতি আমল না করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করারই নামান্তর।

১৬) ছালাতে সিজদা করার সময় সাতটি অঙ্গ পরিপূর্ণরূপে মাটিতে না রাখাঃ আবদুল্লাহ্‌ বিন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতটি অঙ্গের উপর সিজদা করতে আদিষ্ট হয়েছেন। মুখমণ্ডল (নাক ও কপাল) দুহাত, দুহাঁটু, দুপা। (বুখারী) কিছু লোক সিজদা করার সময় দুটি পা সামান্য একটু উঠিয়ে রাখে বা এক পা অন্যটির উপর রাখে। অনুরূপভাবে কেউ কেউ শুধু কপাল মাটিতে রাখে নাক রাখে না। এরূপ করা সুন্নাতের পরিপন্থী।

উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ বলে থাকে সিজদা করার সময় আগে নাক রাখতে হবে তারপর কপাল রাখবে। আর সিজদা থেকে উঠার সময় আগে কপাল উঠাবে তারপর নাক। এরূপ খুঁটিনাটি পার্থক্য ইসলামে কোথাও নেই। এগুলো নিছক বাড়াবাড়ি।

১৭) দুসিজদার মধ্যে তর্জনী আঙ্গুল নাড়ানোঃ একাজ সুন্নাত থেকে প্রমাণিত নয়; বরং প্রমাণিত হচ্ছে, তাশাহ্‌হুদে বসে তাশাহ্‌হুদ পড়াবস্থায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তর্জনী আঙ্গুল নড়াতে হবে। আর এটাই হচ্ছে সুন্নাত।

১৮) তাশাহুদের সময় আঙ্গুল না নড়ানোঃ অধিকাংশ মানুষ শুধুমাত্র আশহাদু আন লাইলাহা বলার সময় তর্জনী বা শাহাদত আঙ্গুল উঠায় এবং ইল্লাল্লাহু… বলার সময় আঙ্গুল নামিয়ে দেয়। এ ধরণের নিয়ম হাদীছে কোথাও বর্ণিত হয়নি। বরং ছহীহ্ হাদীছ অনুযায়ী নিয়ম হচ্ছে তাশাহ্হুদে বসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উক্ত আঙ্গুল উঠিয়ে রাখতে হবে এবং নাড়াতে হবে। “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাম হাতের তালু বাম হাঁটুর উপর বিছিয়ে দিতেন, আর ডান হাতের সবগুলো অঙ্গুলী মুষ্টিবদ্ধ করে তর্জনী দ্বারা কিবলার দিকে ইঙ্গিত করতেন এবং সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন।” (ছহীহ্ মুসলিম)

১৯) তাশাহ্হুদে বসে দরূদ পাঠ করার সময় [সাইয়্যেদেনা] শব্দ বৃদ্ধি করে পাঠ করাঃ হাফেয ইবনু হাজার (রঃ) বলেন, দুয়া যিকিরের ক্ষেত্রে হাদীছে প্রমাণিত শব্দাবলী উচ্চারণ করাই সুন্নাত সম্মত।

তাছাড়া কোন হাদীছ, ছাহাবী বা তাবেঈদের আমল থেকে এর কোন প্রমাণ নেই।

২০) তিন বা চার রাকাআত বিশিষ্ট ছালাতের শেষ তাশাহ্হুদে তাওর্য়ারুক না করাঃ অধিকাংশ মুছল্লী সব ধরণের তাশাহ্হুদে বসে ইফতেরাশ করে। (ইফতেরাশ হচ্ছে, ডান পা খাড়া রেখে বাম পায়ের উপর বসা। আর তাওর্য়ারুক হচ্ছে, ডান পা খাড়া রেখে বাম পাকে ডান পায়ের নীচ দিয়ে সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিতম্বের উপর বসা।) আবু হুমাইদ সায়েদী (রা: ) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দুরাকাতে বসতেন তখন বাম পায়ের উপর বসতেন, ডান পা খাড়া রাখতেন। আর যখন শেষ রাকাতে বসতেন তখন বাম পাকে (ডান পার নীচ দিয়ে) সামনের দিকে বাড়িয়ে দিতেন এবং ডান পা খাড়া করতেন তারপর নিতম্বের উপর বসতেন। (ছহীহ্ বুখারী)